উত্তর-পূর্ব ভারতের “হোলোঙাপার  গিবন অভয়ারণ্য” বন্য মানুষ (Gibbon) এর এক আদর্শ রম্যভূমি। 

ভারতবর্ষের মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষভাবে আসাম হল জৈব বৈচিত্রের এক অতুলনীয় লীলাভূমি। আসামে যে ভাবে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, লতা, পক্ষী, মাছ-কাছিম, স্তন্যপায়ী প্রাণী, বন্য প্রাণী, বিভিন্ন সরীসৃপ, উভচর, কীট-পতঙ্গ, প্রজাপতি ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়, সে ধরনের বৈচিত্রময় প্রাণীকূল ভারতের অন্য কোন রাজ্যে দৃশ্যমান নয়। পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিকতা তথা বন্যপ্রাণীর জন্য এই মুক্ত বিচরণ ভূমি হল প্রকৃতির আশীর্বাদপুষ্ট এই আমাদের মাতৃভূমি, “সূর্য উঠার দেশ” (Sun rising country) নামে খ্যাত আসাম । এই দেশ বৈচিত্রময় বন-জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে থাকার কারনে এর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান বন্য প্রাণীর বাসস্থান গড়ে উঠেছে। কয়েক শতবর্ষের পূর্ব থেকে প্রকৃতি প্রেমী মানুষের অবিচ্ছিন্নরূপে ও অন্তহীন প্রচেষ্টার ফলস্বরূপে হোলোঙাপার অরণ্যকে ১৮৮১ সনে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রূপে স্বীকৃত হয় । মানুষের দ্বারা সৃষ্ট এই অভয়ারণ্য কেবল উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যেই নয় এটি সমগ্র ভারতবর্ষের অন্যতম অভয়ারণ্যরূপে স্বীকৃত হয়েছে। বহু সংখ্যক দুর্লভ বন্যপ্রাণী এবং পক্ষীকুলের দেশী-বিদেশী আবাসস্থল হলো এই অতুলনীয় অরণ্যটি। এই সুরম্য অভয়ারণ্যে অবস্থান করা প্রাণীকুলের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য প্রাণী হল সাতটি প্রজাতির বানর। সম্ভবত ভারতের মধ্যে এই গিবন অভয়াৰণ্য হল একমাত্র বনাঞ্চল যেখানে সাতটি প্রজাতি সমন্বিত বানর একসঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়। এই বানর সমূহ হল – 

১। অসমীয়া বানর (Assamese Macaque) 

২। শুকর লেজি বানর (Pig-tailed Macaque)

৩। স্টাম্প লেজের বানর (Stump tailed Macaque)

৪। টুপি মস্তক বানর (Capped Langur) 

 

  ৫।অসমীয়া মলুয়া বানর(Rhesus Macaque) 

৬। লাজুক বানর (Slow Loris) 

৭। হলক বানর (Hoolock Gibbon) 

এই বানরগুলোর মধ্যে হুলক বানর এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। মানুষের সমাজ ব্যবস্থার মত এই প্রজাতি বানরের সমাজ ব্যবস্থা ও বহু আচরণের সঙ্গে এদের মিল দেখতে পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গভীর অরণ্যে এই ধরনের কিছু এপ বা বনমানুষ দেখতে পাওয়া যায়। সামগ্রিক ভাবে এদেরকে ইংরেজিতে বলা হয় গিবন। আমাদের ভারতবর্ষে মাত্র একটি প্রজাতির বন মানুষ বা এপই দেখতে পাওয়া যায়, যার ইংরেজি নাম হুলক গিবন। যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘বুনো পিথেকাস হুলক’। প্রকৃতপক্ষে মানুষ ও বানর একই গোত্রের অন্তর্গত, যাকে ইংরেজি ভাষায় ‘প্রিমেট্‌চ বলা হয়। ইন্দোনেশিয়ার ওরাং, ওটাং এবং আফ্রিকা মহাদেশের গরিলা, শিম্পাঞ্জি নামে খ্যাত বানর প্রাণীসমূহ এই ‘এপ’ অথবা বনমানুষ সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের আকৃতি অন্যান্য বানরদের মত নয়। এই হুলক বানর শুধু ভারতবর্ষের আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্যে দেখতে পাওয়া যায়। 

এখন আসি, হুলক বানরের আকৃতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে, যদিও এরা বানর প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত কিন্তু এদের আকৃতি ও প্রকৃতি অন্যান্য বানরদের মত নয়। তাদের লেজ থাকে না, হাত দুটির দৈর্ঘ্য পায়ের প্রায় দ্বিগুণ। শরীরের ওজন ছয় থেকে আট কিলোগ্রাম পর্যন্ত হয়। মানুষের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে এদের বহু মিল দেখা যায়। এই প্রজাতির বানরেরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ছোট পরিবার গঠন করে অরণ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে এক একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র অঞ্চলে বিচরণ করে। হুলক পুরুষ বানরের গায়ের রং কালো এবং পূর্ণবয়স্ক মহিলাদের গায়ের রং খয়েরি বা মুগা রং। কিন্তু অপ্রাপ্ত বয়স্ক মহিলার রং হয় কালো। এদের কপালে দুটো সাদা দুদিকে রেখা থাকায় ইংরেজিতে এদের “হোয়াইট ব্রাউয়েড” গিবনও বলা হয়।  

পুরুষ হুলক তার জীবন সঙ্গী হিসেবে স্ত্রী হুলককে বেছে নেয় এবং তার সঙ্গে পুরো জীবন অতিবাহিত করে। এদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এরা কখনো বহুগামী হয় না। হুলক বানরের জীবনসঙ্গী যদি অকালে মারা যায় তবে তারা কখনোই দ্বিতীয়বার বিবাহ করে না। বাকি জীবন এরা অবিবাহিত হয়ে থেকে যায়। মাতৃ হলক ভীষণ স্নেহ প্রবন। সন্তান যখন ছোট থাকে তখন বুকে জড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়। স্ত্রী এবং পুরুষ হুলক দুজনেই অতি আদরের মধ্যে ওদের সন্তানকে বড় করে। এরা গভীর অরণ্যে এক একটি গাছে একটি পরিবারেই বাস করে। আর একটা খুব মজার ব্যাপার হল এরা মানুষের মতই বেড়াতে যায়। এবং তাদের ছেলে বা মেয়ের ঘরে এরা ১০/১৫ দিনের জন্য বেড়াতে যায়। এবং সেখানে খুব আনন্দ করে দিন কাটায়। 

এবার আসি এদের প্রজনন সম্পর্কে। হুলক সাধারণত একটি করে বাচ্চা প্রসব 

করে। সাধারণত হুলক ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাসের মধ্যে সন্তান প্রসব করে। এদের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য হল; হুলক বানর কখনও কখনও অরণ্যভূমি সংলগ্ন সমতল অঞ্চলে নেমে আসে। তাদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র হল সুদীর্ঘ গাছ-গাছালি শাখা-প্রশাখা। হুলক বানরের এই গাছ সমূহের শীর্ষ স্তর থেকে মধ্যস্তর পর্যন্ত খাদ্য সংগ্রহ করে। বর্ষারণ্য হুলক বানরের আদর্শ বাসস্থান। অসমের জোড়হাট, ডিব্ৰুগড় ও তিনসুকীয়া জেলার হোলোঙাপার গিবন অভয়ারণ্য, জয়দিহিং অভয়ারণ্য, আপার দিহিং ও ডিরাক অরণ্য বর্তমানও অনেক হুলকের বিচরণভূমি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা হল এই বিরল প্রজাতির বানর কূল আজ অস্তিত্বের সংকটে 

ভুগছে। গোয়ালপাড়ার একটি পাহাড়ের এতই হুলক বানর ছিল যে পাহাড়ের নামই ছিল ‘হলক কন্দা’। কিন্তু মানুষের ধংসকামি কার্যকলাপের জন্য এই পাহাড় এখন অরণ্য শূন্য, ফলে পাহাড় 

হুলক শূন্য হয়ে গেল। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে, ভারত সরকারের ‘একটি’ প্রাণী সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক সংগঠন “জুলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া” কর্তৃক প্রকাশিত এক তথ্যমতে অসমে ১৯৭১-৭২ সালে হুলক বানরের সংখ্যা ছিল ৭৮,৭০০। কিন্তু বর্তমানে অসমের হুলকের সংখ্যা ৫০০০ থেকে বেশি নয়। চোরাশিকারি ও কুসংস্কারের বলি সর্বোপরি সরকারের উদাসীনতা ও অবহেলার ফলশ্রুতিতে মাত্র ৪০-৫০ বৎসরের মধ্যে এই অরণ্যভূমি থেকে ৭৩,৭০০ হুলক বানর বিলুপ্ত হয়েছে। এই বিরল প্রজাতির হুলক বানরকে বিলুপ্তির করালগ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য তার বাসস্থানকে অধিক কঠোরভাবে সংরক্ষিত করতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনজাগরণ ও হুলক বাসস্থানের চিরস্থায়ী সংরক্ষণ। হুলক বাসস্থান চিরস্থায়ী সংরক্ষণের ও ব্যাপক গণজাগরণ জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতের পরিবেশ সংরক্ষণকারী ও গোষ্ঠী (N.G.O.) ‘হোলোঙাপার নেচার্স সোসাইটি’, ‘নেচার্স বেকন’ও ‘আরণ্যক’অবদান ও ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এই প্রকৃতিপ্রেমী সংগঠন সমূহের আন্তরিক ও নিরলস প্রচেষ্টায় অসমের হুলক বানর সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। অবশেষে সবার প্রতি আবেদন বিশেষভাবে বহির্ভারতে বসবাস করা ভারতীয়রা স্বদেশে আসলে অবশ্যই এই অতুলনীয় পর্যটন ভূমিতে পদার্পণ করে বিশ্বের দরবারে এই বৈচিত্রময় অরণ্যভূমি কে প্রতিষ্ঠিত করুণ। আশা রইল আমাদের সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অসমের অরণ্যভূমি আবার হুলক বানরের সুতীব্র কলধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠুক। 

 

 

 

লেখক – শ্রী হীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী 

প্রাক্তন অধ্যক্ষ