বাঙ্গালি সংস্কৃতি ও কৃষ্টি

সংস্কৃতি ও কৃষ্টি বলতে বুঝায় একটি দেশ বা অঞ্চলের মানুষের জ্ঞান, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, রীতিনীতি, নীতিবোধ, চিরাচরিত প্রথা, সমষ্টিগত মনোভাব এর সমষ্টিকে। ঠিক তেমনি ভাবে বাঙালি সংস্কৃতি বলতে বোঝানো হয় বাঙালিদের সাহিত্য, সংগীত, জীবন ধারা, আচার আচরণের সমষ্টিকে। 

বাঙালির এই সংস্কৃতি একদিনে তৈরি হয়ে যায় নি হাজার হাজার বছর ধরে নানা জাতির আগমন এবং ধর্মীয় গোষ্ঠী, নানা শ্রেণির মিশ্রণ, পারস্পারিক প্রভাব এর  সমন্বয়ের গড়ে উঠেছে বঙ্গীয় সংস্কৃতি। সুলতানি আমলের বাঙ্গালা রাজ্য গড়ে উঠলেও তখনই বাঙালি সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে বিষয়টি এমন নয় বরং বঙ্গীয় সংস্কৃতির ভিত্তি গড়ে উঠেছিলো আরও অনেক আগে থেকেই। 

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এক সময় এই বাংলা ভূখণ্ড একটি নির্দিষ্ট কোন এলাকা ছিল না, এখানে ছিল একাধিক রাজ্য। গৌড়, রাঢ়, দক্ষিণ রাঢ়, সুহ্ম, বরেন্দ্রী, হরিকেল, সমতট এবং বঙ্গ সহ আরও কয়েকটি রাজ্যের অবস্থান  ছিল এই বাংলা ভূখণ্ডে। সর্বপ্রথম  আলাদা ভাবে বাঙালি জাতির সূচনা করেন গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ। ১৩৫০ এর দশকের দিকে গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁ জয় করেন। সেই হিসেবে  বলা যায় বঙ্গীয় সংস্কৃতির বয়স  আট শো অথবা এক হাজার বছর হতে পারে।

ভারতীয় উপমহাদেশে  বঙ্গভূমির ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য এবং বিবিধ নৃতাত্ত্বিক সংমিশ্রণের ফলে এর সংস্কৃতি অন্য সংস্কৃতি গুলো থেকে স্বতন্ত্র কিন্তু কিছু কিছু দিক থেকে অন্য সংস্কৃতির সাথে আবার মিলও রয়েছে। এর কারণ হল, বঙ্গ ভূমির অবস্থান ছিল দিল্লি থেকে শত শত মাইল দূরে উপমহাদেশের একবারে প্রান্তে। যেহেতু দিল্লি থেকে শাসন কাজ পরিচালিত হতো সেহেতু উপমহাদেশের ধর্ম, দর্শন ও ধারণা, সাংস্কৃতিক ধারা, শাসন কাঠামো কিছুটা এখানেও পৌঁছেছে এবং সেটা বাঙালি সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। তবে মিশ্রণ ঘটলেও  সেটা বাঙালির মূল সংস্কৃতিকে খুব বেশি প্রভাবিত করতে পারে নি।

যদি ধর্মীয় সংস্কৃতি বা কৃষ্টির কথা বলি, বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন এবং ইসলাম ধর্মের মতো প্রধান ধর্মের উৎপত্তি-স্থান কিন্তু ছিল বঙ্গভূমি থেকে বহু দূরে। ফলশ্রুতিতে এই সব ধর্মের কোনটিই তার আদি এবং অকৃত্রিম রূপে এই বাংলা অঞ্চলে পৌঁছায়নি। যতটুকু এসেছে সেটা আবার এই অঞ্চলের বিশ্বাস ও আচারে সাথে মিশ্রিত হয়েছে। আর এজন্যই  বঙ্গদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং ইসলাম ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান এবং সামাজিক রীতিনীতির কিছু মিল লক্ষ্য করা যায়। 

সপ্তম শতাব্দীতে যখন  পর্যটক হিউয়েন সাং এদেশে এসেছিলেন তখন তিনি এটি লক্ষ্য করেন এবং জানিয়েছেন, তিনি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী স্থানীয় লোকদের ধর্মীয় দর্শন, আচার-আচরণ এবং সামাজিক রীতিনীতিতে অনেক সাদৃশ্য দেখেছেন। তার লেখায় তিনি আরও উল্লেখ করেন বঙ্গীয় বৌদ্ধধর্ম এবং মুল  বৌদ্ধধর্ম এর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। 

বাঙালি জাতির শুরু থেকেই এই বাঙালি সমাজ ছিল পিতৃতান্ত্রিক ছিল বর্ণভেদ ভিত্তিক৷ কালের স্রোতে বাঙালির জাতিতে আর্য ও আনার্যদের মিশ্রণ ঘটেছে। বঙ্গদেশে আসার পূর্বে   সামাজিক কাঠামো এমন ছিল কিনা সেটা নিশ্চিত না হলেও বলা যায় আর্য আসার পরই মূলত এই ধরণের ভেদাভেদ তৈরি হয়। কারণ আর্যরা যে বৈদিক ধর্ম নিয়ে এদেশে এসেছিল তাতে জাতিভেদ ও বর্ণভেদের উল্লেখ ছিল। জাতিভেদ হিসেবে তখন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন  ব্রাহ্মণদের সংখ্যা কম হলেও তারা ছিল প্রভাবশালী। অনেকের  ধারণা হতে পারে বর্ণভেদ হয়েছিল ধর্মের কারণে কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এমন ভেদাভেদ এর কারণ কেবল ধর্ম নয় এর জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণও জড়িত। 

যাই হোক বঙ্গ দেশে জাতিভেদে মানুষের পেশা নির্ধারিত হতো যেমন বৈদ্য সম্প্রদায় এর লোকেরা ছিল চিকিৎসা পেশার সঙ্গে জড়িত।

বাঙালি সংস্কৃতি ও কৃষ্টির ইতিহাস এতটাই বিস্তৃত যে একটি লেখনীতে শেষ করা সম্ভব নয়। যাই হোক এতক্ষণ অতীত কালের সংস্কৃতির ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা জানলাম এবার চলে আসি বর্তমানে। মূলত বাঙালিরা এখনো তাদের চির চারিত সংস্কৃতিকে লালন করে তবে কালের বিবর্তনে সমাজ আধুনিক হওয়ায় জীবন যাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।