বাঙালির ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আজকের সৃষ্টি নয়।  বিগত ১৪০০ শ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে বাঙালির বাঙালিয়ানা । কালের বিবর্তনে সময়ের সাথে বাংলার পোশাক-আশাক এবং সাজসজ্জায়  পরিবর্তন এলেও মূল জাতিগত বৈশিষ্ট এখনো অটুট আছে বিশ্বের  সব বাঙালিদের মধ্যে। সময় এবং যুগের সাথে পশ্চিমা কৃষ্টির প্রভাবে বাঙালির পোশাক-আষাক এবং সাজসজ্জাতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। এ যুগের বাঙালি যেমন পশ্চিমা দেশের আদলে পোশাক পরিধান করে তেমনি বিভিন্ন পূজা পার্বণ এবং দেশীয় উৎসবে  জাতিগত পরিধান পড়ে গর্ববোধ করে। 

রেনেঁসা যুগ(১৮৭০): বাংলা সংস্কৃতি গঠিত হয়েছে তৎকালীন পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলার সমন্বয়ে। ১৮৭০ সাল  ছিল বাংলা সংস্কৃতির রেনেসাঁ যুগ।এই যুগে বাংলা শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা এবং বিজ্ঞানে অনেক সাফল্য লাভ করেছিল।  এই যুগে মহান কবি রবীন্দ্রনাথ টেগর এর লেখা গল্প, উপন্যাসের চরিত্র অনুসারে মেয়েরা “ব্রাহ্মীকা ড্র্যাপ” স্টাইলে শাড়ী এবং ছেলেরা লম্বা কোট ও পাঞ্জাবি এর সাথে ধুতি পড়া শুরু করে।  পরে দেবদাস,পরিনিতার মতো মুভিগুলোতে এই স্টাইলটি লক্ষ্য করা যায়।  

এডওয়ার্ডিয়ান যুগ(১৯০০): ১৯০০ শতকে রাজা এডওয়ার্ড সন অফ রানী ভিক্টোরিয়া ক্ষমতায় আসলে তার প্রভাব পরে বাঙ্গালীর জীবনযাত্রায়।  ২০ শতকের গোড়ার দিকে মসলিন শাড়ির বর্ডার এ ভারী বিডস এর কাজ লক্ষ করা যায়।এডওয়ার্ডিয়ান স্টাইলের ব্লাউস সেলাই করার চল দেখা যায় এই যুগে। এডওয়ার্ডিয়ান স্টাইল ব্লাউসের সামনের অংশে থাকতো ল্যাপেল এবং ব্লাউসের হাতা ছিল একটু ফোলানো সাথে ভারী এমব্রয়ডারির কাজ । ছেলেরাও এডওয়ার্ডিয়ান স্টাইল এর স্যুট পড়তো এবং নিজ হাভেলিতে পড়তো ধুতি আর পাজামা। এই যুগে বাংলার পোশাক-আশাকে প্রথম “fusion-wear” এর সূচনা ঘটে।  

উদ্দীপ্ত ২০(১৯২০): ১৯২০ শতকে বাংলার পোশাক-আশাক এবং সাজসজ্জায় বেশ সাহসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।  এই যুগের মেয়েরা  চুলে বব কাট, ঠোঁটে ডার্ক লিপস্টিক এবং প্রচুর স্বর্ণের গহনায় নিজেদের সাজাতে ভালোবাসতো। বড়দার মহারাণী গায়েত্রী দেবী এবং প্রিন্সেস ইন্দিরা দেবীর অনুকরণে মেয়েরা আধুনিক পোশাক যেমন চীফন বা মসলিন শাড়ী পরিধান করে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পছন্দ করতো।

আধুনিক ৬০(১৯৬০): ৬০ শতক ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অন্বেষণের যুগ। এই যুগের আধুনিকতা পোশাক-আশাকে নতুনত্বের জন্ম দেয়। এই যুগের বিখ্যাত অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর এর অনুকরণে মেয়েরা পুফি স্টাইল, সূক্ষ ফ্রেঞ্চ বেণী ধাঁচে চুল বাধা শুরু করে।  হাতা কাটা ব্লাউজ, চীফন শাড়ি এবং বডি স্যুট ছিল এই যুগের পোশাকের হাইলাইট। 

আধুনিক পোশাকের জনক শর্মিলা ঠাঁকুর

মুক্তিযুদ্ধের যুগ (১৯৭০): ১৯৭০ সাল ছিল বাংলার ইতিহাসের স্মরণীয় যুগ। পাকিস্তানের সাথে অনেক বছর যুদ্ধের পরে ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলা স্বাধীনতা লাভ করে এবং পরিনিত হয় বাংলাদেশ নামে।  মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ছাপ পরে বাঙালির পোশাক- আশাকে।  উজ্জ্বল পলিস্টার এবং চকচকে কাপড়ের তৈরী পোশাক এই সময়ের প্রধান বৈশিষ্ট। আঁটোসাঁটো সালোয়ার কামিজ এবং প্লাটফর্ম হীল ছিল মেয়েদের নিত্যদিনের সঙ্গী।  

সালোয়ার কামিজ এবং প্লাটফর্ম হিলে প্রতিবাদী নারী 

মুঘল পুনরুজ্জীবন (১৯৯০): ৯০ শতাব্দীতে বাঙালির ফ্যাশনে মুঘল যুগের পুনরাবির্ভাব লক্ষ করা যায়। মুঘল যুগের পোশাকে আধুনিক টুইস্ট ছিল এই সময়ের মূল ফ্যাশন। আনারকলি স্টাইল এর সালোয়ার কামিজ এর প্রচলন দেখা যায়। এছাড়া টার্টলনেক সোয়েটার, ঢিলে-ঢালা ডেনিম জিন্সএ মেয়েরা বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করতো। এই যুগেই  শাড়ি নিত্যদিনের পোশাক থেকে মাঝে-মধ্যে পরিধানের বস্ত্রে পরিণত হয়।  

 আনারকলি স্যুট 

আধুনিক যুগ/মিলেনিয়াম যুগ (২০০০-২০১০): আধুনিক যুগে বাঙালি পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণে জিন্স, টপ জাতীয় পোশাক পরিধান করে।  এখনকার যুগে মহিলাদের শাড়ি শুধুমাত্র বিশেষ অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পড়তে দেখা যায়। শাড়ির মধ্যে সিল্ক, মসলিন, টিস্যু কিংবা জর্জেট শাড়ি বেশি জনপ্রিয়।

আধুনিক শাড়ী 

২০২০ এবং আসন্ন: বাঙালির প্রধান পোশাক শাড়ি এখন নিত্যদিনের পোশাক  থেকে আনুষ্ঠানিক পোশাকে পরিনিত হলেও শাড়ির চাহিদা এখনো কমে যায় নি। বরং অনেক পুরাতন ট্রাডিশনাল  শাড়ি  নতুন আঙ্গিকে এবং নতুন নকশায় আধুনিক মেয়েরা পরিধান করে থাকে। ঢাকার নারায়ণগঞ্জ এ তৈরী জামদানি শাড়ি এমনি এক টাইমলেস শাড়ি।  ২০১৩ সালে উনেস্কো জামদানি শাড়ি বুননের প্রক্রিয়াকে   “অদম্য সংস্কৃতিক ঐতিহ্য” এর প্রতীক হিসাবে ঘোষণা করে। জামদানি শাড়ি বহু শ্রমিক বহু মাস ধরে হাতে সেলাই করে তৈরী করে থাকে। আধুনিক যুগে বিশেষ অনুষ্ঠানে মেয়েদের জামদানি শাড়ি পরার প্রচলন দেখা যায়।