Lokoshanshkriti
একটি দেশের লোকের আত্মপরিচয় তাদের জীবন ধারার সমষ্টিই হচ্ছে লোকসংস্কৃতি। লোকসংস্কৃতি একদিনে গড়ে উঠে না, কালের বিবর্তনে এটি বিকশিত হয়, মানুষের জীবনের সাথে মিশে যায়৷ লোকসংস্কৃতিকে ভাঙ্গলে আমরা মূলত দুটি শব্দ পাব, লোক ও সংস্কৃতি। এখানে লোক বলতে সাধারণ মানুষকে এবং সংস্কৃতি বলতে বুঝায় মানুষের জীবনযাপন, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, ভাষা পদ্ধতি, যোগাযোগ এবং আচর-আচরণ, এ সবগুলোর সমষ্টিকে। আর এই দুয়ে মিলে হয়েছে লোক সংস্কৃতি।
লোক সংস্কৃতি হচ্ছে একটা কৃত্রিমতা বহির্ভূত জীবন ধারার সমষ্টি। এটি সহজাত একটি বিষয়। এটা সব সময় তার গতিতে চলে। আধুনিক কথ্যরীতির বাইরে গ্রামীণ মানুষের সেই চির-চারিত মুখে ভাষা লোক সংস্কৃতির অংশ। লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে প্রকাশ পায় গ্রামীণ মানুষের সুখ দুঃখ ভরা জীবনধারা। গ্রামীণ লোকগান, সাহিত্য, উৎসব, খেলাধুলায় প্রকাশ পায় লোকসংস্কৃতি৷
একটি দেশের বিভিন্ন সংস্কৃতি
বাংলার সংস্কৃতিকে বিভিন্ন সময় মানুষ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছেন। কেউ কেউ একে আদিম সংস্কৃতি, লোক সংস্কৃতি এবং নগর সংস্কৃতিতে বিভক্ত করেছে।
নগর জীবনে মানুষের জীবন ধারাকে বলা হয় নগর সংস্কৃতি, এটি কৃত্রিমভাবে তৈরি এখানে মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় না। অন্য সংস্কৃতির অনুকরণের ফল হচ্ছে নগর সংস্কৃতি। একটি দেশের আদিম জনগোষ্ঠীর জীবন ধারা, তাদের সাহিত্য, গান এর সমষ্টি হচ্ছে আদিম সংস্কৃতি। আর এই আদিম সংস্কৃতির হাত ধরেই লোক সংস্কৃতির উদ্ভব।
বাংলার লোকসংস্কৃতি
কৃষি প্রধান এই দেশ প্রাচীন কাল থেকেই কৃষির জন্য বেশ উপযুক্ত ছিল। সোনা ফলানো এই মাটির টানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এখানে এসেছে এবং বসতি স্থাপন করেছে। ফলে এই দেশে মিশেছে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ভাষার মানুষ। বিভিন্ন জাতি যেমন আর্য, শক, কোচ, মেচ, ইরানি, তুর্কী, সেন, আরবিয়, আফগান, মোগল, পাঠান আফ্রিকান, ইউরোপীয়, উলন্দাজ, ইংরেজ, বিহারি, পাকিস্তানি, আরাকানি, এদেশে এসেছে তাদের আচার আচরণ নিয়ে সেটি বাংলা গ্রহণ করেছে এবং হয়ে গেছে এদেশের লোক সংস্কৃতির উপাধান।
বাংলার লোক সংস্কৃতির উদাহরণ দিতে গেলে এমন কিছু সংস্কৃতি তুলে ধরতে হবে যেগুলোর সাথে এ দেশের মানুষ যুগ যুগ ধরে পরিচিত, যেগুলো রয়েছে প্রতিটা বাঙালির হৃদয় জুড়ে।
নৌকা বাইচ
নৌকা বাইচ হচ্ছে এক ধরণের প্রতিযোগিতা বা খেলা৷ প্রায় ৬৫০ মিটার দূরত্বে প্রতিযোগিতা হয়। নৌকাতে একাধিক চালক থাকে, কখনো ৭, ২৫ এবং কখনো ৫০ জন চালক থাকতে পারে। নদীমাতৃক ভূমি হওয়ার এখানে এই ধরনের খেলা গুলো প্রাচীন কাল থেকেই জনপ্রিয়।
বাংলায় নৌকা বাইচের আয়োজন করা হয় মূলত ভাদ্র-আশ্বিন মাসের দিকে। এই সময়ে নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকে যা বাইচের জন্য উপযুক্ত সময়। সাহস এবং শক্তি সঞ্চার করতে সব চালকরা এক সাথে গান করে অথবা ধর্মীয় গানের কলিতে নিজেদের মানসিক ভাবে সচল রাখে। বাইচের সময় নৌকা গুলাকে সুন্দর সুন্দর নাম দেয়া হয় যেমন, ময়ূরপঙ্খি, অগ্রদূত, দীপরাজ, সোনার তরী।
নৌকা বাইচের প্রচলন করেছিল বাংলার রাজা মহারাজারা সেই ধারাই এখনো প্রবাহ মান রয়েছে।
ষাঁড়ের লড়াই
ষাঁড়ের লড়াই বাংলার জনপ্রিয় একটা খেলা এবং এর প্রচলন হয়েছে বহু বছর আগে থেকে। ফসল তুলার পর কৃষকরা নিজেদের গোয়ালের ষাঁড় দিয়ে এই খেলার আয়োজন করতো। খেলা দেখতে কয়েক গ্রামের মানুষ জড়ো হতো এক জায়গায়৷ তবে খেলাটি এখন বিলুপ্তির পথে। তাছাড়া বিভিন্ন জায়গায় খেলাটিকে নিষিদ্ধও করা হয়েছে।
ষাঁড় লড়াই এর কয়েক দিন আগে কয়েক গ্রামে মাইক বা ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয়া হতো। যে ষাঁড় গুলোকে লড়াইয়ে পাঠানো হবে সেগুলোকে সন্দর করে সাজিয়ে আনা হতো, তাদের দেহে শোভা পেতো বিভিন্ন রঙের রঙিন কাপড়।
বাংলাদেশের দেশের নড়াইল, বাগেরহাট এবং মৌলভীবাজারে এক সময় নিয়মিত ষাঁড়ের লড়াই আয়োজন করা হতো। এখন যদিও সেটা অনিয়মিত হয়ে গেছে।
Photo Credit: Bhorerkagoj
মোরগ লড়াই
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এবং বেশ জনপ্রিয় একটি খেলা ছিল মোরগ লড়াই৷ বাংলাদেশ এর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল এলাকায় এখনো এই খেলাটি দেখা যায়। যেকোনো মোরগ দিয়ে এই লড়াই হয় না। এজন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মোরগ। দুটি মোরগকে একটি সার্কেলের মধ্যে দিয়ে লড়াই লাগানো হয়।
একটির আক্রমণে অন্যটি আহত বা মারা গেলে অথবা বৃত্ত থেকে বের হয়ে গেলে প্রতিযোগিতার সমাপ্তি ঘটে। অনেকে বলে থাকে বহু বছর আগে পারস্যে এই খেলার উদ্ভব ঘটেছিল। আগে জনপ্রিয় থাকলেও নিষিদ্ধকরণ এবং বিভিন্ন কারণে মোরগের লড়াই আগের মত দেখা যায় না।
লাঠি খেলা
বাংলার লোক সংস্কৃতির আরেকটি অংশ হচ্ছে লাঠি খেলা৷ নেচে আত্মরক্ষার কৌশল তুলে ধরা হয় এখনে। যে লাঠি খেলে তাকে বলা হয় লাঠিয়াল। যেকেউ চাইলেই এই খেলায় অংশ নিতে পারে না। এই খেলার জন্য প্রচুর অনুশীলনের দরকার পড়ে।
লাঠি খেলাটি মূলত আত্মরক্ষা শেখায়। এক সময় এই বাংলায় জমিদাররা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য লাঠিয়াল নিযুক্ত করতো। লাঠি খেলায় লাঠি গুলো তৈলাক্ত হয়। যদিও এখন আগের মত লাঠি খেলার চর্চা নেই তবে এখনো উত্তর বঙ্গে বিভিন্ন পূজা উৎসবে লাঠি খেলার প্রদর্শনী করা হয়।
বায়োস্কোপ
বাংলাদেশ, পশ্চিম বঙ্গ তথা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি ঐতিহ্য হচ্ছে বায়োস্কোপ৷ বাহারি রঙ্গের কাপড় পড়ে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেটে দেখা যেতো বায়োস্কাপওয়ালাদের। বায়োস্কাপওয়ালাদের শব্দ শুনেই শিশুরা দৌড়ে বের হতো ঘর থেকে এবং বায়স্কোপের ছিদ্র দিয়ে রঙিন ছবি উপভোগ করতো।
কী চমৎকার দেখা গেল এইবারেতে আইসা গেল, ঢাকার শহর দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল।’- এমন বিভিন্ন সুরে বায়োস্কোপওয়ালা একেক করে বায়োস্কোপ এর ছবি পালতো। কখনো বায়োস্কোপে স্থান পেতো রাজা মহারাজাদের কৃতিত্ব।
Photo Credit : Channelionline
যাত্রা-পালা
যাত্রা পালা বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। অতীতে শীতের সময় গ্রামে গ্রামে বসতো যাত্রা পালা। ছেলে বুড়ো সবাই সেই সব নাট্যাভিনয় উপভোগ করতো। যাত্রা মূলত মঞ্চ নাটকের মত, অভিনেতারা তাদের অভিনয়ের মাধ্যমে কখনো দর্শককে কাদায় আবার কখনো হাসায়।
তবে বর্তমানে আগের মত যাত্রাপালা দেখা যায় না, অশ্লীলতার জন্য এটি হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার লোক সংস্কৃতি থেকে।
শেষ কথা
বহুকাল ধরেই আমাদের লোকসমাজ জুড়ে আছে এই সংস্কৃতি গুলো। এই আর্টিকেলে কয়েকটা লোক সংস্কৃতির উদাহরণ দেয়া হলে এগুলো ছাড়াও আরও অনেক লোক সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ দুই বাংলা।
আধুনিকতার স্রোতে হারিয়ে যেতে বসেছে বিভিন্ন লোক সংস্কৃতি যা হাওয়া একদমই উচিৎ নয়। প্রতিটি বাঙালির উচিত তার এই লোকসংস্কৃতি রক্ষণে দায়িত্ববান হওয়া।