সংস্কৃতি ও কৃষ্টি 

পৃথিবীর প্রতিটি দেশের রয়েছে আলাদা আলাদা কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। মানুষের জীবন ধারা, ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক রীতিনীতির সংমিশ্রণে তৈরি হয় একটি দেশের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি। এক দেশের সাথে অন্য দেশের সংস্কৃতি কিছুটা মিল থাকলেও পুরোপুরি মিল পাওয়া অসম্ভব। ভৌগোলিক ভাবে কাছাকাছি অবস্থান করা দেশ গুলোর সংস্কৃতিতে মিল পাওয়া অসম্ভবের কিছু না, তবে তুলনা মূলক দূরে অবস্থিত দেশ গুলোর সংস্কৃতির মিল পাওয়া অলিক কল্পনা হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের সাথে ভারতের সংস্কৃতির অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে কিন্তু বাংলাদেশের সাথে সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার সংস্কৃতির মিল খুঁজা বোকামি। 

সংস্কৃতি বা কৃষ্টি একটি আপেক্ষিক বিষয়, কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারবে না কোনটি আদর্শ সংস্কৃতি বা কৃষ্টি। একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশের সংস্কৃতি যতই ভাল হোক সেটা চাইলে অন্য দেশে গ্রহণ করা যাবে না। জন্মের পর থেকে মানুষ নির্দিষ্ট একটি পরিবেশে এবং সংস্কৃতিতে বড় হয় সুতরাং তাকে চাইলেই নতুন কোন কৃষ্টিতে অভ্যস্ত করানো যাবে না। একটি দেশের সংস্কৃতি যেমন রাতারাতি তৈরি হয়ে যায় না তেমনি চাইলেই হঠাৎ করে এটি পরিবর্তন করা যাবে না। 

বাংলার সংস্কৃতি ও কৃষ্টি 

বাঙালি একটি সংকর জাতি৷ কালের ধারায় বিভিন্ন জাতি এই ভূখণ্ডে এসেছে শাসন করেছে এবং তাদের সংস্কৃতি কৃষ্টি এ দেশে রেখে গেছে। হিন্দু শাসন, বৌদ্ধ শাসন, মুসলমান শাসনের মাধ্যমে বাংলায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন রীতিনীতি। সব সংস্কৃতি বাঙালি গ্রহণ করেছে এমনটি বলা যাবে না। কিছু কিছু গ্রহণ করেছে কিছু বর্জন করেছে আবার কিছু সংস্কৃতি জায়গা করে নিয়েছে অভ্যস্ততার জন্য। 

Photo Credit:  Samakal

বাংলার কৃষ্টির বহিঃপ্রকাশ

বাঙালির কৃষ্টি কালচার ফুটে উঠে তার কাপড় চোপড় এবং জীবনযাত্রায়। বাংলা সংস্কৃতির নির্দিষ্ট ধাঁচ আছে যা দেখে বুঝা যায় মানুষটা বাঙালি। বাংলা সংস্কৃতি মানব মনে বিকাশে ও ধরে রাখতে এই বাংলার কবি সাহিত্যিকের অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মীর মশাররফ হোসেন এর মত সাহিত্যিক ও কবিরা ছিলেন সংস্কৃতির বাহক৷  

বাংলার শিল্পকলায় রয়েছে এই অঞ্চলের কৃষ্টির ছাপ। ক্যানভাসে ফুটে উঠে আবহমান বাংলার চিরচারিত রূপ। কখনো বা গ্রামীণ রমণীর কর্মব্যস্ত জীবন কখনো লাঙ্গল হাতে কৃষকের মাঠে যাওয়া আমাদের সামনে তুলে ধরে চিরচেনা বাংলাকে। বাঙালি কৃষ্টিকে শিল্প কলায় তুলে ধরতে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা হলেন, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক, সাইফুদ্দিন আহমেদ, এবং এস এম সুলতান, শফিকুল আমিন, রশিদ চৌধুরী। 

Photo Credit:  Youtube

বাংলা কৃষ্টির আরও কিছু উপাদানের মধ্যে রয়েছে গ্রাম বাংলার নকশিকাঁথা, জামদানি শাড়ী।টাঙ্গাইলের তাতের জামদানী শাড়ী দেশে বিদেশে বেশ জনপ্রিয়, এইসব শাড়ী দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির ধারক। আর এই তাত শিল্পের উন্নতির মুলে রয়েছে উপজাতিরা। 

নকশি কাঁথা বাংলাদেশের লোকশিল্পের একটি উপাদান। রঙ বেরঙের সুতা দিয়ে তাতিরা নকশি কাঁথা তৈরি করে৷ দেশের অনেক জায়গায় নকশি কাঁথা তৈরি হয় তবে ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ফরিদপুর ও যশোর এই শিল্পের জন্য বিখ্যাত। কাঁথা তৈরির পর সেগুলোতে মনের মাধুরী মিশেয়ে চিত্রাঙ্কন করা হয়। নকশী কাঁথায় ফুটে উঠে ফুল লতা পাতা পাখির ছবি। 

 বাংলা কৃষ্টির বড় একটা অংশ জুড়ে আছে পুঁথি৷ ৫০-৬০ বছর আগেও বাংলার ঘরে ঘরে পুঁথি পাঠের প্রচলন ছিল৷ রাত হলেই গ্রামীণ জীবনে নেমে আসতো দারুণ রোমাঞ্চকর রাত, দাওয়ায় বসতো পুঁথি পাঠের আসর৷ পুথিতে কখনো জায়গা পেতো রাজা মহারাজদের বীরত্বের কাহিনী কখনো বেদনা বিধুর বেহুলা লখিন্দর এর কাহিনী। 

বাঙালির আচরণগত কৃষ্টি

বাঙালির কৃষ্টি মিশে আছে তার আচরণে। আচরণগত দিক দিয়ে বাঙালি মিশুক একটি জাতি। যেকেউকে আপন করে নেয়ার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে বাঙালির মধ্যে। বাঙালির আচরণগত কৃষ্টি তুলে ধরা হল।

বাঙালি খাদ্য রসিক

বাঙালি প্রাচীন কাল থেকেই খাদ্য প্রিয় বা খাদ্য রসিক। বাঙালির ছিল গোলা ভরা ধান গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ। দৈনিক খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন পদের রান্না বাঙালির চিরচারিত অভ্যস্ততা। বাঙালি হিন্দু সমাজে এটি বেশি দেখা যায়। বাহারি রকমের খাবার দিয়ে উপস্থাপন করা হয় দুপুরের খাবার ও রাতের খাবার। 

Photo Credit:  Bhorerkagoj

তাছাড়াও ঋতুভেদে বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয় পিঠা উৎসব। নতুন ধান ঘরে তুলার আনন্দে সেগুলো দিয়ে তৈরি করা হয় বাহারি রকমের পিঠা, পায়েস।

অতিথি পরায়নতা

বাঙালি অতিথি আপ্যায়নে বরাবরই সেরা। সুপ্রাচীন কাল থেকে বাঙালি অতিথি পরায়ণ। পরিচিত অপরিচিত অথিতিদের আপ্যায়ন বাঙালি জাতিসত্তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। বাঙালি অতিথিদের ভাবে লক্ষি৷ গ্রাম বাংলায় অতিথি এলে গাছে ডাব পেরে খাওয়ানো, গৃহপালিত হাস মুরগী ধরে অতিথি খাওয়ার মধ্যে বাঙালি দারুণ তৃপ্তি খুঁজে পায়। 

বাঙালি উৎসব প্রিয়

বাঙালি উৎসব প্রিয় একটা জাতি। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। বাঙালির রয়েছে বিভিন্ন ধরণের সামাজিক উৎসব, জাতীয় উৎসব এবং ধর্মীয় উৎসব। সব ধরণের উৎসব বাঙালি ধুমধাম করে পালন করে। উৎসবে জাতি বর্ণ ধর্মের ভেদাভেদ নেই বাঙালির মধ্যে। 

আড্ডাবাজ বাঙালি 

অতিথি পরায়নতা ও মিশুক বাঙালির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা আড্ডাবাজ। সারা দিন কাজের পর গ্রামে চা স্টল গুলোতে বসে আড্ডা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িতে রাত আড্ডা যেন থামতেই চায় না। বাঙালি কাজের সময়ে যেমন কঠোর পরিশ্রমী তেমনে অবসরে আড্ডাবাজ।

শেষ কথা 

বাঙালি কৃষ্টি কালচার বাংলার মানুষের হৃদয়ে এবং মননে মিশে আছে কেউ চাইলেই এটি পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে না। বাঙালি জাতির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে যেমন, অতিথিপরায়ণতা, উৎসব, ইত্যাদি অন্য যেকোনো জাতি থেকে বাঙালিদের আলাদা করেছে।